ফিরে পাওয়া
শিবানী আর অনিমেষ—এই দুটি নাম একসময় ছিল একাত্ম। ছোটবেলা থেকেই তারা একসাথে খেলত, হাসত, আর গ্রামের প্রতিটা রাস্তায় তাদের পায়ের ছাপ পড়ে থাকত। তাদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। শিবানী আর অনিমেষের পরিবারের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল, আর সেই সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল তাদের বন্ধুত্ব। এক পিঠের নিচে দুজনের বসা, একসাথে আমগাছের নিচে দুপুর কাটানো, কিংবা নদীর ধারে বসে গল্প করা ,এইসব ছিল তাদের শৈশবের রোজকার গল্প।
কিন্তু হঠাৎই সবকিছু পাল্টে গেল। শিবানীর বাবা কলকাতায় একটা চাকরির সুযোগ পেলেন। এই সুযোগ ছিল তাদের পরিবারের জন্য অনেক বড়। শিবানীর পরিবার ঠিক করল, তারা কলকাতা চলে যাবে। এক সন্ধ্যায় অনিমেষের বাড়িতে শিবানী এসে খবরটা দিলো। দুজনের চোখে তখন নীরব জল। অনিমেষ কিছু বলতে পারল না, শুধু তাকিয়ে রইল শিবানীর দিকে। তার মনে হচ্ছিল, যেন একটা অংশ তার ভিতর থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শিবানীরও কিছু বলার ছিল না, শুধু এক গভীর শূন্যতা নিয়ে সেদিন সে বাড়ি ফিরল।
কলকাতা চলে যাওয়ার পর শিবানীর জীবন একেবারেই বদলে গেল। বড় শহরের নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন জীবন। কিন্তু তার হৃদয়ে সবসময় থেকে গেল গ্রামের সেই ছোট্ট বাড়িটা, আর অনিমেষের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। শিবানী চিঠি লিখত অনিমেষকে, আর অনিমেষও লিখত তাকে। প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন থাকলেও, তাদের সম্পর্ক ছিল সেই পুরনো চিঠির মতোই, ধীরে ধীরে, নীরবে বেড়ে ওঠা।
এই কুড়ি বছর ধরে তারা একে অপরকে না দেখেও এক অদৃশ্য সুতোর বন্ধনে বাঁধা ছিল। তাদের চিঠির মধ্যেই ছিল ভালোবাসার উষ্ণতা, বন্ধুত্বের গভীরতা। শিবানী প্রতিবার কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবত, অনিমেষ কি এখনো আগের মতোই আছে? সে কি আমায় মনে রেখেছে? আর অনিমেষও প্রতিদিন গ্রামের নদীর পাড়ে বসে শিবানীর কথা ভাবত, "কলকাতার শহরে শিবানী কি আমায় মনে করে?
এইভাবে চলল কুড়ি বছর। জীবনের নানা বাঁকে অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা অটুট থেকেছে। শিবানী কলেজ শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠিত চাকরি পেল, আর অনিমেষও তার বাবার জমিতে কৃষিকাজ শুরু করল। দুজনের জীবন একদিকে গেলেও, চিঠির মাধ্যমে তাদের সম্পর্কটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেল। কিন্তু কখনোই দেখা হয়নি তাদের, শুধু মনের গভীরে একে অপরের ছবি আঁকা ছিল।
একদিন হঠাৎ করেই শিবানী সিদ্ধান্ত নিল, সে কলকাতার বইমেলায় যাবে। বই পড়ার অভ্যাস তার ছোটবেলা থেকেই ছিল, আর বইমেলায় যাওয়া তার স্বপ্ন ছিল অনেকদিনের। সে সেদিন বইমেলায় একা বেরিয়ে পড়ল। চারপাশে অসংখ্য বইয়ের দোকান, আর মানুষের ভিড়। শিবানী ধীরে ধীরে একটা স্টলে গিয়ে একটা বই দেখছিল। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনল, শিবানী? শিবানী অবাক হয়ে পেছনে তাকাল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনিমেষ। সময়ের সাথে কিছুটা বদলে গেলেও, তার চোখ দুটো এখনো ঠিক আগের মতোই গভীর। শিবানীর হৃদয় যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। এত বছর পরে, এত দূরত্বের পরেও, অনিমেষকে দেখে তার মনে হলো, যেন সময় থমকে গেছে।
অনিমেষ ? শিবানীও অবাক হয়ে বলল।
অনিমেষ কিছু বলার আগেই, শিবানী তার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। এই কুড়ি বছর ধরে জমে থাকা অনুভূতি, অপেক্ষা, ভালোবাসা সব যেন এক মুহূর্তে প্রকাশ পেল তাদের চোখে। দুজনেই একে অপরকে দেখতে পেল, যেমনটা তারা মনে মনে এঁকে রেখেছিল।
কেমন আছিস ? অনিমেষ ধীরে ধীরে বলল। তার গলায় একটু কাঁপন ছিল।
ভালো, শিবানী মৃদু হেসে বলল। আর তুই ?
ভালো, অনিমেষ বলল, কিন্তু তার চোখে ছিল আবেগের ঝিলিক।
শিবানী আর অনিমেষ বসে পড়ল বইমেলার এক কোণে। তারা শুরু করল গল্প। কত কথা জমে ছিল! শিবানী জানতে পারল, অনিমেষের জীবন গ্রামে কেমন কেটেছে। সে এখনও প্রতিদিন সেই নদীর পাড়ে বসে, যেখানে তারা একসময় বসত। আর অনিমেষও জানতে পারল, কেমন করে শিবানী তার নিজের জীবন গড়েছে কলকাতার মতো বড় শহরে।
তারা এতক্ষণ ধরে গল্প করতে থাকল যে সময়ের খেয়ালই ছিল না। বইমেলার ভিড় ধীরে ধীরে কমতে লাগল, কিন্তু শিবানী আর অনিমেষের গল্পের ধারা যেন শেষ হওয়ার নয়। তাদের মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না, কুড়ি বছরের দূরত্ব যেন এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
একসময় শিবানী বলল, অনিমেষ, তুই কি জানিস, আমি কতোদিন ধরে তোর এই চেহারা মনে মনে এঁকে রেখেছি ?
অনিমেষ মৃদু হেসে বলল, আমি তোকে ভুলিনি রে, আমিও তোকে মনে মনে দেখতাম। কিন্তু এখন তো সামনে আছিস, বাস্তবে।
শিবানী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, এই কুড়ি বছরে তুই আমায় ভুলে যাসনি, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।
অনিমেষ তার চোখে তাকিয়ে বলল, ভুলে যাওয়া কি এত সহজ? শিবানী, তুই আমার জীবনের অংশ, সেটা কল্পনায় হোক বা বাস্তবে।
আকাশে তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে। বইমেলার আলো জ্বলে উঠেছে। শিবানী আর অনিমেষের গল্প কিন্তু শেষ হয়নি। তারা জানত, জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে তারা একে অপরকে হারাবে না। কুড়ি বছরের ব্যবধান, দূরত্ব, সময় সবকিছু তাদের ভালোবাসার সামনে হার মেনেছে।
শিবানী বলল, অনিমেষ, আমাদের কি আবার দেখা হবে ?
অনিমেষ মৃদু হেসে বলল, অবশ্যই হবে।
তাদের জীবনে অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসা ছিল স্থির, অটুট। সেই বইমেলায় তাদের যে সাক্ষাৎ হলো, তা যেন ছিল তাদের জীবনের নতুন শুরুর ইঙ্গিত।
শিবানী আর অনিমেষের সম্পর্কটা কুড়ি বছর ধরে এক অদৃশ্য সুতোর টানে বাঁধা ছিল। তারা এতদিন একে অপরকে দেখেনি, কিন্তু তাদের ভালোবাসা ছিল অটুট। বইমেলায় হঠাৎ দেখা হওয়ার পর, তাদের বন্ধন আরও গভীর হলো। তারা বুঝতে পারল, এই সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেই বন্ধুত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছে এক গভীর ভালোবাসা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন