শিউলি
শিউলি শহরের নামী-দামী পরিবারের মেয়ে। ১৮ বছর বয়স, কলেজে পড়ছে। বাবার বড় ব্যবসা, মায়ের সমাজে প্রভাবশালী উপস্থিতি। ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে তার সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো। শিউলি দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ভালো, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও জনপ্রিয়।
কিন্তু এর মাঝেও সে কিছুটা একাকী। বড়লোকি আড়ম্বরের মাঝে শিউলির নিজস্বতা যেন হারিয়ে গেছে। তবে তার ভেতরে একজন আলাদা মানুষ বাস করে—যে সাধারণ জীবনের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করে, যেখানে মায়া আছে, ভালোবাসা আছে।
সন্তু একেবারে বিপরীত বাস্তবতার মানুষ। গ্রামের ছোট্ট এক চাষি পরিবারের ছেলে। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও সন্তুর পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রবল ইচ্ছে এবং জেদ। তার বাবার দিন মজুরের কাজ, মায়ের অল্প জমির আয়ে সন্তুর কলেজে যাওয়া কঠিন হলেও, সে নিজের পরিশ্রমে বৃত্তি নিয়ে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে।
শহরের বিলাসী পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরুতে একটু কষ্ট হলেও সন্তুর সংকল্প অটল। তার চোখে স্বপ্ন, একদিন সে অনেক বড় হবে, মা-বাবার কষ্টের দিনগুলোকে দূরে সরিয়ে সুখ এনে দেবে।কলেজে প্রথমবার শিউলি আর সন্তুর দেখা হয় যখন তারা একই গ্রুপে প্রজেক্ট করতে বাধ্য হয়।
শিউলি তার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব আর বিলাসী জীবনের কারণে সবার নজরে থাকে, কিন্তু সন্তুর মধ্যে শিউলি দেখতে পায় এক অদ্ভুত সরলতা এবং একাগ্রতা। প্রথমদিকে শিউলি সন্তুর দিকে তেমন নজর দেয়নি, তবে সন্তুর দারিদ্র্য এবং বিনয় শিউলির মনকে আকর্ষিত করে। সে বুঝতে পারে, সন্তু একেবারে অন্যরকম, তার চারপাশের ছেলেদের মতো নয়। সন্তুর চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর হৃদয়ে ছিল পরিবারকে ভালো রাখার অদম্য ইচ্ছা।
প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার সময় শিউলি সন্তুর সঙ্গ আরও বেশি উপভোগ করতে শুরু করে। সন্তুর আন্তরিকতা, সরলতা এবং পরিশ্রম তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। শিউলির বিলাসবহুল জীবন থেকে এক ভিন্ন বাস্তবতার ছোঁয়া সন্তুকে অবাক করে, কিন্তু তার মনোযোগ সবসময় কাজ এবং পড়াশোনার দিকে। শিউলির সঙ্গে সময় কাটিয়ে সন্তু বুঝতে পারে, তার জীবনের কষ্টের সঙ্গে শিউলির জীবনের প্রাচুর্যের মধ্যে এক ধরনের গভীর শূন্যতা রয়েছে।
তাদের সম্পর্কের সূচনা হয় প্রজেক্টের বাইরে পড়াশোনা নিয়ে আলাপের মাধ্যমে। সন্তু প্রায়ই শিউলির বাড়িতে যায় কাজের জন্য। প্রথমদিকে শিউলির মা-বাবা সন্তুকে শুধু আরেকজন সহপাঠী হিসেবে দেখতেন, কিন্তু যখন সন্তুর পোশাক ও কথা-বার্তায় তাদের গ্রামের দরিদ্র পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট হয়, তখন তারা সন্তুকে নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে শিউলির বাবা-মায়ের নজর পড়ে যে শিউলি সন্তুর সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছে।
একদিন শিউলির মা তাকে সরাসরি বলেন, "এত দরিদ্র ঘরের ছেলের সঙ্গে তোমার এত ঘনিষ্ঠতা ভালো দেখায় না। আমাদের সমাজে এভাবে মানায় না।" শিউলি মায়ের কথায় প্রচণ্ড রাগ করে, কিন্তু সে বুঝতে পারে, তার পরিবার কখনোই তাদের সম্পর্ককে মেনে নেবে না। সন্তু তো একেবারে ভিন্ন জগৎ থেকে এসেছে, যেখানে তার জীবনের সংগ্রাম আর শিউলির বিলাসিতার মধ্যে কোন মিল নেই।
তবে শিউলি আর সন্তুর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা সহজে ভাঙার নয়। শিউলি ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সে সন্তুকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। সন্তুর জন্য তার হৃদয়ে এক আলাদা অনুভূতি জন্মায়—এক ধরনের নিরাপত্তা এবং সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি। সন্তু সবসময়ই জানত, শিউলির মতো মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনো সমাজে মেনে নেওয়া হবে না। সে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু শিউলির প্রতি তার ভালোবাসা দিনে দিনে বেড়ে যায়।
একদিন শিউলি সরাসরি সন্তুকে জিজ্ঞাসা করে, "তুমি কেন আমাকে এড়িয়ে চলছ? আমরা তো বন্ধু, আমাদের মধ্যে কিছুই বদলায়নি।" সন্তু মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, "শিউলি, তুমি আমার জন্য অনেক বেশি ভালো। তোমার জীবন অন্যরকম, আমার জীবন অন্যরকম। আমি তোমার ভালো চাই, কিন্তু আমরা কখনো এক হতে পারব না।"
শিউলি তখন সন্তুকে তার মনের কথা বলে। সে জানায়, "আমার জীবনে সবকিছু আছে, কিন্তু ভালোবাসার এই অনুভূতিটাই ছিল না। তুমি আমাকে সেই ভালোবাসা দিয়েছ। আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে চাই, কোনো ফারাক আমার জন্য কোনো ব্যাপার নয়।"
সন্তু অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকায়। সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা কখনোই ধনী বা দরিদ্র বোঝে না, বোঝে শুধু হৃদয়ের সম্পর্ক।তাদের ভালোবাসা ধীরে ধীরে গভীর হয়, কিন্তু সমাজের চোখে এ সম্পর্ককে মেনে নেওয়া কঠিন।
শিউলির মা-বাবা তাদের সম্পর্ক নিয়ে শিউলির উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে, আর সন্তুও বুঝতে পারে তাদের ভালোবাসার পথ কঠিন হবে। তবে শিউলি এবং সন্তু দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয়, তারা একে অপরকে ছেড়ে যাবে না। শিউলি সন্তুর পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
তাদের সম্পর্কের পরীক্ষা আসে যখন শিউলির বাবা তাকে অন্য একজন ধনী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। শিউলি দৃঢ়তার সঙ্গে জানায়, সে সন্তুকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। সন্তুও শিউলির সঙ্গে একত্রে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, যত কঠিনই হোক।শেষমেশ, শিউলি আর সন্তু তাদের ভালোবাসার জয়লাভ করে।
শিউলির পরিবার ধীরে ধীরে সন্তুর প্রতিভা এবং পরিশ্রম দেখে তাদের সম্পর্ক মেনে নিতে শুরু করে। ভালোবাসা এবং আত্মবিশ্বাসের জোরে তারা সকল বাধা অতিক্রম করে। শিউলি এবং সন্তু মিলে প্রমাণ করে, ভালোবাসা কেবল অর্থ কিংবা সামাজিক অবস্থান নয়, এটি হল হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন