গল্প: অপেক্ষার রূপকথা
শীতল ছিল শহরের ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। চোখে-মুখে স্বপ্ন, মনোযোগ কলেজের পড়াশোনায়। জীবন ছিল সোনার খাঁচায় আবদ্ধ এক রূপকথার গল্পের মতো। সবই চলছিল ঠিকঠাক, তবে হঠাৎ একদিন কলেজের পথে পরিচয় হয় রীতমের সাথে। রীতম, যে বস্তির এক ভিখারী ছেলে, সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করে নিজের পেটের জোগাড় করে। তার চোখে স্বপ্ন নেই, শুধুই বাঁচার লড়াই।
কিন্তু কেমন করে যেন শীতল ও রীতমের মাঝে একটি অদ্ভুত টান তৈরি হয়। শীতল যেন রীতমের ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে পায়, তার সাদামাটা জীবনযাপন তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। শীতল জানতো যে এই প্রেমের সম্পর্ক তার পরিবার কখনও মেনে নেবে না, কারণ তার পরিবারে সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা ছিল সবার ওপরে।
তবুও, প্রেমের টান যে কোনো বাধা মানে না। শীতল সিদ্ধান্ত নেয়, পরিবার-সমাজের তোয়াক্কা না করে রীতমকে নিয়ে পালাবে। তারা পালিয়ে যায় এবং এক অতি সাধারণ মন্দিরে বিয়ে করে। তাদের বিয়ের পর জীবন শুরু হয় এক নতুন বাস্তবতায়— যেখানে ধন-সম্পদ নেই, নেই সামাজিক স্বীকৃতি। শীতল স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছিল, কারণ রীতমই ছিল তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু বিয়ের পরের জীবনটা এত সহজ ছিল না। অভাবের সংসারে প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল শীতলকে। রীতম তাকে যতটা ভালোবাসতো,ঠিক ততটাই তার মন কুঁকড়ে থাকতো শীতলের জন্য।সে জানতো, শীতল তার পরিবারের কাছে যে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিল, তা থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছে। তাই একদিন, সংসারের দায়িত্ব পালনে এবং স্ত্রীকে ভালোভাবে বাঁচানোর স্বপ্নে,রীতম পাড়ি জমায় দিল্লিতে কাজের সন্ধানে।
দিল্লি যাওয়ার দিন ছিল এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। শীতল রীতমকে বিদায় জানিয়ে আশা করেছিল, শীঘ্রই আবার তারা একসাথে হবে। কিন্তু সেদিন যে ট্রেন রীতমকে নিয়ে দিল্লি যাচ্ছিল, সেটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সে দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায় এবং অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিখোঁজদের মধ্যে ছিল রীতমও।
শীতলের পৃথিবী যেন থেমে গেল। শীতল আশাহত হয়েছিল, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। পরিবারের সবাই তাকে নতুন জীবন শুরু করতে বলেছিল। কিন্তু শীতল জানতো, রীতম বেঁচে আছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে কোথাও। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেল। সময়ের সাথে শীতল সংসারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হলো। কাজের খোঁজে পথে পথে ঘুরতে লাগলো। কিন্তু কখনোই সে রীতমের জন্য অপেক্ষা ছাড়েনি।
দশ বছর কেটে গেছে। শীতল দিনগুলোকে কাটিয়েছে কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে। তবুও তার ভালোবাসা তাকে শক্তি জুগিয়েছে। তার পরিবার তাকে বারবার বলেছে নতুন জীবন শুরু করতে, কিন্তু শীতল জানতো, রীতম তার কাছে ফিরবে।
একমাত্র ভরসা ছিল তার ভালোবাসা। একদিন হঠাৎ করে তার দরজায় এক অপরিচিত লোক এসে দাঁড়ায়। সে লোকটি ছিল অবিকল রীতমের মতো, কিন্তু আরও ক্লান্ত, আরও বিধ্বস্ত। শীতল প্রথমে চিনতে পারেনি, কিন্তু লোকটির চোখের চাহনি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতের স্মৃতিতে। চোখের পানি ঝরতে লাগলো শীতলের। দশ বছর পর রীতম ফিরে এসেছে।
রীতম অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিল। দিল্লির সেই দুর্ঘটনার পর তাকে এক গ্রামে আশ্রয় নেয়া হয়েছিল, তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল কিছুদিনের জন্য। বহু কষ্টে সে নিজের পরিচয় ফিরে পেয়েছে, আর সেই পরিচয়ের টানেই শীতলের কাছে ফিরে এসেছে।
শীতল ও রীতম আবার একসাথে হল। তাদের জীবন আবার নতুন করে শুরু হয়েছিল, তবে এবার অভাব-অনটন আর প্রতিকূলতার মধ্যেই তারা নিজেদের ভালোবাসা আরও শক্তভাবে আবিষ্কার করলো। শীতল জানতো, জীবনের সবকিছু পেয়ে গেলেও যে সুখ সে রীতমের সাথে পেয়েছে, তা আর কোনো কিছুতে সম্ভব নয়।
রীতমও জানতো, তার সব কষ্ট, সব সংগ্রামের শেষে শীতলই ছিল তার একমাত্র ভালোবাসার ঠিকানা। তারা একে অপরকে পেয়েছে, এবং এবার কেউ তাদের আলাদা করতে পারবে না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন